সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৯ অপরাহ্ন
ভোলা প্রতিনিধি॥ ইট ভাটার মালিক খাল বাঁধ দিয়ে মাটি নেয়ার ফলে খাল পাড়ের দুইটি সড়ক খালের গর্ভে চলে গেছে। এতে বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ও হাসাননগর ইউনিয়নের চার নাম্বার ওয়ার্ডের প্রায় তিন হাজার মানুষ যাতায়াতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।এছাড়া খালের দুই পাশের ঘরবাড়ি, দোকানপাট,গাছপালা ভেঙ্গে পড়ছে। কাচা সড়ক ভেঙে যাওয়ায় কোন পরিবহণ চলাচল করতে পারছেনা।
বড় ধরণের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে শতাব্দী প্রাচীণ স্থানীয় হাকিমুদ্দিন বাজারটিও হুমকীর মুখে পড়বে বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন। এছাড়া হাকিমুদ্দিন ফাজিল মাদ্রাসা, হাকিমুদ্দিন আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম হাসাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একদিকে ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকবে অপরদিকে করোনাকাল শেষ হলে শিক্ষার্থীদের চলাচলে ভোগান্তির শেষ থাকবেনা। কারণ বাজারের পাশেই মেঘনা নদী। সংযোগ সড়কের পাশ ভেঙে পড়ছে।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের সীমান্তে মেঘনা নদী শুরু হয়ে হাসান নগর ও টবগী ইউনিয়নের মধ্যে হাকিমুদ্দিন বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেতুয়া খাল। চওড়া ওই খালটির এক অংশ খাসমহল বাজার সংলগ্ন বেড়ীবাঁধ ও অপর অংশ মৃজাকালু মাছ ঘাট হয়ে পুনরায় মেঘনায় মিশেছে। প্রবাহমান ওই খালটি ইটভাটার মালিক জসিমউদ্দিন হাওলাদারকে ইজারা দেন প্রশাসন। ভাটার মালিক দুইপাশে বাঁধ দিয়ে খাল কেটে ৩৫-৪০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নেন। খালের কোন ঢাল না রাখায় মাটি নেয়ার এক মাস পর থেকে প্রতিদিন পাড়ের সড়ক ভেঙ্গে লোকালয়ের দিকে চওড়া হচ্ছে।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা(ভারপ্রাপ্ত)নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) বশির গাজী জানান, দখলমুক্ত রাখতে মাছ চাষের জন্য জসিমউদ্দিন হাওলাদারকে ডিসিআর কেটে এক বছরের জন্য ইজারা (খাস কালেকশন)দেয়া হয়েছে। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মালেক জানান, জলাধার আইনে খালে বাঁধ দেয়া যায়না। কী কারণে খাল কাটা হচ্ছে তা স্থানীয় প্রশাসন ভালো বলতে পারবেন।ভোলা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মামুন আল ফারুক বলেন, প্রবাহমান খাল কখনই বন্দোবস্তো বা ইজারার(খাস কালেকশন)উপযুক্ত না। তবে বদ্ধজলাশয় হলে বার্ষিক ডিসিআর কেটে মাছচাষের জন্য ইজারা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু খনন করে মাটি নেয়া যাবে না।
জানা যায়,তেতুলিয়া নদী থেকে উঠে আসা বেতুয়া খালটি ভোলার ছয়টি উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে চরফ্যাশন সংলগ্ন মেঘনা নদীতে মিশেছে। ভাঙনের কারণে অনেকাংশ মেঘনা নদীতে বিলীন হয়েছে। যে কটি অংশ আছে তার একটি বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমুদ্দিন বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর হাসাননগনর ও টবগী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার।
স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় এসএনএস নামক ইটভাটার মালিক জসিমউদ্দিন হাওলাদারের লোকজন গত মে মাসে বেতুয়া খালের দুই স্থানে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মাটি কেটে নেয়। দুইটি ভেকু মেশিন (খননযন্ত্র) দিয়ে দ্রুত মাটি কেটে ভাটায় নেয়। কিছু মাটি সড়ক ভেঙে যাবার কারণে খালের একপাশে স্তুুপ করে রেখেছেন। এ খনন কাজ পরিচালনা করেন মো. কামাল হোসেন। এলাকাবাসি প্রতিবাদ করলে কামাল প্রতিবেশীদের ঘর ভেঙে দেয়ার হুমকি দেন। পরে তারা চুপ হয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে জোয়ারের পানি বাড়লে খালের দুই তীরে ভাঙন শুরু হয়। সেই থেকে ভাঙন ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
সরজমিনে দেখা যায়, এতে দুই পাড়ের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি, দোকনপাট ও সড়ক ভেঙে পড়েছে। হাসানগর ইউনিয়নের চার নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. শফিক, মো. রফিক,ইব্রাহিম,আবুল কাশেম, আহসানউল্যাহ জানান, খালপাড়ের ওই সড়ক দিয়ে হাকিমুদ্দিন,খাসমহল, মাছঘাটে অটো, অটোরিক্সা, সাইকেল মোটর সাইকেল চলাচল করতো। এখনতো রাস্তাই নেই। তাঁরা জানান, ভাটার সময় উত্তর দক্ষিণে কয়েকটি সাঁকো বানিয়ে তাঁরা কোন রকম চলাচল করেন। কিন্তু জোয়ারের সময় তা সম্ভব হয়না। টবগী চার নাম্বার ওয়ার্ডের শফিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম,মনির হোসেন, পিয়ারা বেগম,জাকির মাষ্টার সহ অনেকে জানান, ঘর থেকে বেরোনোর পথ ভেঙে যাবার কারণে ঘরপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা করে ভেকুর মালিককে দিয়ে রাস্তা কোন রকম মেরামত করিয়ে চলাচল করছেন।
এলাকাবাসী জানান, খালের মাঝে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ার কারণে আশপাশে প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার বর্ষায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ফসলি খেতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া খালপাড়ের হাকিমুদ্দিন-খাশমহল বাজার ঝুঁকিতে আছে। টবগী ৪ নাম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, খালের তীরের কুলসুম বেগম,মোজাম্মেল হক, জামাল হোসেনসহ ৪৫ টি পরিবার খালের তীরে ভাঙনের মুখে পড়েছেন। তার কারণে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে তীর বাঁধিয়েছেন। তারপরেও ভাঙন অব্যাহত আছে।
হাসাননগর ইউনিয়নের ৪ নাম্বার ইউপি সদস্য মো. ফিরোজ বলেন, ইউএনও’র ইটভাটার মালিককে খাল কেটে মাটি নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত হয়নি। এতে ১০-১২টি পরিবার, দোকানপাট ও সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টির কারণে তারা চুপ আছেন। বর্ষা কমলে তারা আন্দোলনে নামবেন। হাসাননগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মানিক হাওলাদার বলেন, খাল কেটে মাটি ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে। নিষেধ করলেও শোনেনি। তাদের নাকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাটি কাটার জন্য ইজারা দিয়েছেন। অথচ পরিষদ কিছু জানে না।
একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি সালাউদ্দিন কাঞ্চন বলেন, খালের দুই পাড়ের ক্ষতিগ্রস্থরা তাঁর কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছে, তিনি ভাটার মালিককে সড়ক সংস্কার করে দিতে বলেছেন। টবগী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল আহসান চৌধুরী জানান, শুকনা মৌসুমে ওই সড়ক মেরামতের পরিকল্পনা ছিলো। এখন আর মেরামতের অবস্থায় নেই। ইটভাটা চক্রকে বারবার নিষেধ সত্ত্বেও মাটি কেটে নিয়েছে। ভেকু ম্যানেজার কামাল হোসেন এলাকাবাসীকে হুমকী দেয়ার কথা অস্বীকার করেন।ইটভাটার মালিক জসিমউদ্দিন হাওলাদার একবার ডিসিআর(খাস কালেকশন) নেয়ার কথা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে জানান, তিনি খালটি নিয়েছেন মাছ চাষের জন্য। কিন্তু মাছ ছাড়তে পারেননি। তবে তিনি সড়ক সংস্কার করে দিবেন।
Leave a Reply